
মুকুলের নির্যাতনের গল্প, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সেইদিনই প্রথম বাবা আমাকে লেখাপড়া বাদ দিতে বলেছিলেন।
বাবার মুখে এই কথা শুনে আমার হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তখনও আমি ভাঙা হাত পা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
বাবা আমাকে তেমন কিছুই দিতে পারেননি, সাহস ছাড়া। অল্প আয়ের একজন কাঠমিস্ত্রী বাবা পেলে অনেকের অনেক অভিযোগই হয়তো থাকতো, আমার ছিলো না। বরং বাবাকে নিয়ে আমি গর্বই করতাম সবসময়। চাইলেই আমাকে কাজে নিয়ে যেতে পারতেন। তাতে সংসারের উপকার হতো, উপকার হতো তারও। কিন্তু বাবার একটাই কথা ছিলো, পড়তে হবে। যা কিছুই হয়ে যাক কেন, পড়াশোনা ছাড়া যাবে না।
রায়পুরা সরকারি কলেজ ছিলো আমার বাসা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ভাড়া ৬০ টাকা। এই টাকাটা দেওয়ার সামর্থ্য বাবার ছিলো না। কিন্তু ঐ যে, সাহস ছিলো। বাবার সেই সাহস বুকে নিয়েই আমি এতো দূরের পথ হেঁটে যেতাম। হেঁটে আসতাম। পা ধরে আসতো আমার। ক্লান্ত লাগতো, অসহ্য লাগতো।বাট তখনই বেজে উঠতো বাবার বলা সেই কথাটা, থেমে গেলে চলবে না। তোমাকে পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে।
অথচ সেই বাবাই আজ আমাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোমার পড়াশোনা করতে হবে না বাপ। তুমি বেঁচে থাকলেই আমি খুশি।
ইন্টারের লেখাপড়া কঠিন। শুধু সাহস দিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা সহজ, তবে ভালো রেজাল্ট করা কঠিন।সেই কঠিন কাজটাও আমি করে ফেলেছিলাম, কিন্তু এডমিশনে যেয়ে ধাক্কাটা আমাকে খেতেই হলো । যেখানে খাওয়াই ঠিকঠাক হতো না, সেখানে প্রাইভেট পড়াটা ছিলো বিলাসিতা। ফলাফল? প্রথমবার ইউনিভার্সিটিতে চান্সটা আমার হলো না, ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে।
কিন্তু তখনও বাবার কথাটাই কানে বাজতো, থেমে যাওয়া চলবে না। পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে হবে।
আমিও চালিয়ে গিয়েছিলাম। মূলধন? বাবার থেকে পাওয়া স্বপ্ন আর সাহস। সেই সাহসের উপর ভর করেই দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম বরিশাল ইউনিভার্সিটিতে।
ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর সবার আনন্দ হলেও আমার হলো ভয়। ভর্তির টাকাটা যোগাড় করতে পারলেও থাকা খাওয়ার টাকাটা ঠিকমতো জোগাড় করা গেল না। বৃহস্পতিবার রাতটা ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের জন্য খুব আনন্দের একটা রাত হয়। দুইদিন ছুটি। সবাই রিল্যাক্সই করতো। আর আমার বৃহস্পতিবারের রাতগুলো হতো ক্লান্তির। শুক্র আর শনিবারের দিন মজুরির টাকা দিয়েই আমাকে চলতে হতো কি না!!
কিন্তু তারপরেও আর চলছিলোই না।মেসের বিল দিলে খাওয়ার টাকা থাকতো না। খাওয়ার টাকা থাকলে মেসের বিল দেওয়া হতো না। আতঙ্ক ছিলো, ভয় ছিলো, পরের বেলায় কী খাবো, সেই অনিশ্চয়তাও ছিলো। কিন্তু সাহসটাও ছিলো। সামনের পথ কঠিন জানি, কিন্তু পেছনের পথটাও কি কঠিন ছিলো না?
সেই সাহসের উপর ভর করেই মেস ছেড়ে উঠে পড়লাম মসজিদে। মাথার উপর ছাদ তো হলো, কিন্তু খাবার? শেষপর্যন্ত আমার অর্থনৈতিক সমস্যা আর লুকিয়ে রাখা গেল না। ডিপার্টমেন্টে বলেই ফেললাম। স্যাররা আমার জন্য একটা রুমও ঠিক করে দিলো। মসজিদ থেকে আমার নতুন ঠিকানা হলো রুম নাম্বার ৫০২০, বঙ্গবন্ধু হল।
না, নতুন হলে এসে আমার নতুন জীবন শুরু হয়নি। আগের মতোই পরের বেলায় কী খাবো, সেই চিন্তায় ঘুম আসে না। মাঝেমধ্যেই মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যাই। তখন স্যাররা সাহস দেন। বাবার কথা মনে পড়ে। আমি আর সব ছেড়ে যেতে পারিনা।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমি টিউশনি করা শুরু করি। আমার ছোটবোনটাও এই সময় জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে চান্স পায়। নিজের খরচের সাথে যোগ হয় ওর খরচও। আমি টিউশনির পরিমাণ বাড়িয়ে দিই। ক্লাস শেষে যাই। গভীর রাতে ফেরত আসি। অনেকেই মনে করি টিউশনি একটা সাধারণ চাকরি। আসলে তা না। টিউশনি হলো নিজের ক্যাম্পাস লাইফকে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে সওদা করা। আমি এখন সেই জীবনের সওদাগর।
১২ অক্টোবর ২০২৩। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও রূপাতলী থেকে টিউশনি শেষ করে ক্যাম্পাসে ফিরছি। পথেই দেখি আমার ইমিডিয়েট জুনিয়র ব্যাচ, মানে ১১ তম ব্যাচের পোলাপাইন দল বেঁধে হাঁটছে। প্রশ্ন করলে উত্তর দিলো, ওরা আমাদের ব্যাচের সাথে দেখা করার জন্য যাচ্ছে। এই দেখা করার অর্থ হলো র্যাগ দেওয়া।
খটকা লাগলো। প্রথমত, আমি নিজেও দশম ব্যাচ। অথচ এই দেখা করার ব্যাপারটা কিছুই জানি না। দ্বিতীয়ত র্যাগ ব্যাপারটাকেই আমার অত্যন্ত অশ্লীল লাগে। অথচ র্যাগ না দিয়েও আমাকে সেই অভিযোগের ভাগীদার হতে হচ্ছে।
আমি আমাদের ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপে মেসেজ দিয়ে বসি যে তোমাদের র্যাগ দিতেই যদি মন চায়, নিজেদের নামে দাও। ব্যাচের নাম খারাপ করার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে?
মেসেজটা দিয়ে আর অপেক্ষা করিনি। খেতে শুরু করি। ঠিক এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠে। তখনও জানতাম না, এই ফোনটা বদলে দিতে যাচ্ছে আমার পুরো জীবন!!
ফোনের ওপাশে ছিলেন ৮ম ব্যাচের মঞ্জু ভাই। তিনি আমাকে জরুরি ভাবে শেরে বাংলা হলে ডেকে পাঠান। এমনকি খাওয়ার বা নামাজের সময়টাও দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। আমি হাত ধুয়ে উঠে পড়ি। রেডি হই। তখনও বুঝিনি, এই ডাকটা কতটা ভয়ঙ্কর এক ডাক ছিলো।
শেরে বাংলা হলে আর যেতে হয় না। আমি তখন এতোটাই "গুরুত্বপূর্ণ" একজন মানুষ যে, মঞ্জু ভাই নিজেই চলে এসেছেন আমার আছে। এরপর আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন ৫ তলায়। ৪০১৯ নাম্বার রুমে।যে রুম থেকে পরবর্তীতে অর্ধমৃত অবস্থায় আমাকে বের করা হয়।
রাজনৈতিক আলাপ সবসময়ই আমার আছে বিরক্ত লাগে। ৪০১৯ নাম্বার রুমে সেই বিরক্তির মধ্যে দিয়েই আমাকে যেতে হচ্ছে। কারণ আমাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে মঞ্জু ভাই তার রাজনৈতিক সার্কেলে রাজনীতির আলাপ করতে শুরু করে দিয়েছেন।
সময়টাকে আমার মনে হতে লাগলো অনন্ত কাল। অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো। মঞ্জু ভাই আর শিহাব ভাই সবাইকে বের হয়ে যেতে বললেন। আমাকে ছাড়া।
ঘড়ির কাটায় ততক্ষণে প্রায় রাত এগারোটা। দরজা লাগানোর পর আমার কাছে উনাদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, আমার সমস্যাটা কী? আমি উত্তর দিতে পারি না। র্যাগের মতো খারাপ জিনিস অপছন্দ করা আবার সমস্যা হলো কবে থেকে? পুরো ইউনিভার্সিটি জুড়ে থাকা র্যাগ বিরোধী পোস্টারগুলো কি তবে মিথ্যা?
এরপর বোঝা গেল, আমার সমস্যা হলো, আমার জন্য উনারা আমাদের ব্যাচের উপর কর্তৃত্বটা পূর্ণ করতে পারছেন না। গ্রুপে মেসেজ দিয়ে সেই সমস্যা আমি আরো বাড়িয়ে দিয়েছি।
যতই বোঝাতে চেষ্টা করি যে মেসেজ আমি দিয়েছি শুধু জানার জন্য। উনারা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। বরং দাবি করতে থাকলেন, আমি আসলে তাদের গ্রুপের বিরোধিতা করার জন্যই মেসেজটা গ্রুপে দিয়েছি। অথচ ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর থেকে আমি না করি কোন দল, না করি কোন রাজনীতি। যার দিন আর পরিবার দুইটাই চলে টিউশনির টাকায়, তার রাজনীতি করার সময় কই?
এই সহজ কথাও উনাদের বোঝানো কঠিন হয়ে গেল। হুট করে আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে মেসেঞ্জার হোয়াটস্যাপ সব চেক করতে শুরু করলো। আমার বিরক্ত লাগলেও ভয় লাগে নাই। কারণ, কোন কানেকশন আমার নাই যেইটা খুঁজে পেলে আমার সমস্যা হতে পারে।
কিন্তু সমস্যা শেষ পর্যন্ত হলো। কিছু খুঁজে না পাওয়ার পরেও হলো। মঞ্জুর যখন আমাকে নানান প্রশ্ন করতে ব্যস্ত, তখন শিহাব ভাই খাটের নিচ থেকে একে একে বের করে আনছেন দা, রড, স্ট্যাম্প আথ লাঠি। আমার সমস্ত সাহস উড়ে যায়। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার বাবা মায়ের মুখ, ছোটবোনের খরচ। আজ আমার কিছু হয়ে গেলে তার পড়ার খরচ কে দেবে?
আমি শিহাব ভাইয়ের পা ধরে ফেলি। কোন দোষ না থাকার পরেও দোষ স্বীকার করি। বলি, আমি মেসেজটা ডিলিট করে দিচ্ছি।
শিহাব ভাইয়ের রাগ কমে না একটুও। হিসহিস করে উঠে, এখন ডিলিট করে কোন লাভ আছে? ভাইরাল তো করেই ফেলেছিস।
ভাইয়ের চোখ দেখে আমার ভয় হয়। মেরে ফেলবে না তো?
আমি ওয়াদা করি, আর কোনদিন আমি গ্রুপে কিছু লিখবো না। আমাকে মাফ করে দেন। আমি আবারও শিহাব ভাইয়ের পা ধরি।
ঠিক এমন সময়, আমার উপর প্রথম আঘাতটা আসে। শিহাব ভাইয়ের পা ধরা অবস্থায় মঞ্জু আমাকে মারতে শুরু করে। আমি সাথে সাথে মঞ্জুর পা ধরতে যাই, তখন শিহাব আমাকে মারতে শুরু করে। নিজেকে আমার মনে হতে থাকে ফুটবলের মতো, যাকে তৈরি করাই হয়েছে লাত্থি মারার জন্য!! পার্থক্য হলো, লাথিটা লাগে ফুটবলের গায়ে। আর ওদের কিল ঘুষি পড়তে থাকে আমার মাথায়। একটানা প্রায় ৩০ মিনিট মার খাওয়ার পর দেখি আমার প্যান্ট ভেজা। আমি প্রস্রাব করে দিয়েছি কখন, আমি নিজেও জানি না।
আমি শিহাব ভাইয়ের পা ধরে ফেলি আবারও।
অসহায় মানুষ খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়।আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম শিহাব ভাইয়ের পা ধরে। ভাইয়ের কাছে ওয়াদা করি, আমি লেখাপড়া ছেড়ে কালকে বরিশাল চলে যাবো। আপনাদের কথা আমি কাউকেই বলবো না। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দেন। আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি সবাইকে বলবো আমি উপর থেকে পড়ে গেছি, তাও আমাকে একটু বাঁচতে দেন।
কান্নার শক্তি ছিলো না। চোখ দিয়ে পানি পড়তেই আছে টপ টপ করে। চোখের পানিরও তো একটা সীমা আছে, তাই না?
আমার কথা শুনে ওদের করুনার বদলে রাগ আরো বেড়ে গেল।
এবার উনারা আমাকে মারতে শুরু করলেন পাইপ দিয়ে। আবিষ্কার করি, আমার বাম হাতটা ভেঙে ঝুলে গেছে। পুরো শরীরের এক ইঞ্চিও জায়গা নাই যেখানে পাইপের বাড়ি পড়েনি। ঘড়ির কাটায় খুব সম্ভবত দুইটাই হবে তখন, ব্যথা যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি।এমন সময় কিছুক্ষণের জন্য ওরা মারা অফ করে। এবারের মতো বোধহয় প্রাণে বেঁচেই গেলাম!!
কিন্তু একটু পর, আমি আমার চোখের সামনে দেখি আজরাইল দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে চোখ মেলে আবিষ্কার করি, শিহাব আর মঞ্জু ভাই আমার বুকের উপর পাড়া দিতে শুরু করেছে। এতক্ষণ অন্তত নিঃশ্বাসটা চলছিলো, এবার সেইটাও বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎই আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা জ্বলতে শুরু করে। ওরা জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আমার শরীরে ছ্যাকা দিতে শুরু করেছে!! যন্ত্রনায় আমি চিৎকার করতে থাকি। আমার চিৎকারে বিরক্ত হয়েই কি না, সেই জ্বলন্ত সিগারেট এবার গুজে দেওয়া হয় আমার মুখে।
আমার ভয়ঙ্কর কাশি শুরু হয়। মৃত্যুর আগেই আমার জাহান্নাম দর্শন সম্পন্ন হয়। পার্থক্য হলো,জাহান্নামে মৃত্যু থাকে না। এখানে মৃত্যু আছে। মৃত্যুকে মনে হতে থাকে মায়ের মতোই আপন। যেন একবার মরে যেতে পারলেই অবসান হবে আমার সমস্ত দুঃখ আর কষ্টের।
শুনেছি মৃত্যুর আগে মানুষের তাদের আপনজনের কথা মনে পড়ে। আমারও মনে পড়তে থাকে। বাবার হাত ধরে হাটে যাওয়া, মায়ের আচল বা বোনের খুনসুটি। আমার ভীষণ কান্না পায়।
সময় ঠিক মনে নাই। তবে ঘড়ির কাটায় আনুমানিক তখন রাত সাড়ে তিনটা। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখী মানুষের কান্নার সময়।
এমন সময় কান্নার আওয়াজ শুনে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেপেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। সারা শরীরে নির্যাতনের দাগ দেখে অনেকেই কিছু বলতে পারে না। কেউ কেউ সাহস করে বলেই ফেলে, ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে না গেলে আর বাঁচানো যাবে না।
তখনও আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। এটা দেখে ইমরান নামের এক ছেলে দৌড়ে আমার রুমে যায় ইনহেলার আনতে। ওর ধারণা ছিলো, আমার শ্বাসকষ্ট আছে আগে থেকেই। আমার বন্ধুরা এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে। কারণ, আমার কখনোই শ্বাসকষ্ট ছিলো না, ছিলো না কোন ইনহেলারও।
ওরা যখন আমার রুমে গিয়ে ইনহেলার খুঁজছে, ৪০১৯ নাম্বার রুমে তখন চলছে আরেক নাটক। আমি মেঝেতে পড়ে আছি বিধ্বস্ত অবস্থায়। কিছু ছেলেপেলে আমাকে হাসপাতালে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু মঞ্জু আর শিহাব মতামত দেয়,এখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সিসিটিভিতে ধরা পড়ে যাবে আবরারের লাশ নেওয়ার মতো। আমরা ফেসে যাবো।তারচেয়ে ও এখানেই থাকুক।
আমার আর হাসপাতালে যাওয়া হলো না। শেষমেশ হাসপাতাল না, ওয়াশরুমে যেতে চাইলাম। প্রস্রাব করতে। সেটাও করতে দেওয়া হলো না। একটা বোতল দিয়ে রুম বন্ধ করে দেওয়া হলো।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বোতলে প্রস্রাব করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তবে সেটা নিয়ে খুব বেশি আফসোস করার সময় আমি পাইনি। কারণ, এর কিছুক্ষণ পরেই আমি জ্ঞান হারাই।
জ্ঞান ফিরে দেখি একটা মুখ ভয় পাওয়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত আমার নাকের কাছে। চেক করছে আমি বেঁচে আছি কি না। আমি ওকে চিনতে পারি। আদনান খান রাফি। আমার এই অবস্থা দেখেই হয়তো রাফির একটু মায়া হয়।সে কাঁধ এগিয়ে দেয়। রাফির কাধে ভর দিয়েই আমি ওয়াশরুমে যেতে পারি।
সকালে রাফি আর জাফর মিলে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
হাসপাতালে আমাকে ৫ দিন থাকতে হয়েছিলো। তবে এই ৫ দিনের কারাদন্ডই শেষ না, বরং ১৮ তারিখে আমাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। বিভিন্ন টেস্ট করার পর ডাক্তাররা নিশ্চিত হন, দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসা না পাওয়ায় আমার ভাঙা হাতের জয়েন্টের মাঝখানে একটা ইনফেকশন দেখা দিয়েছে।
আর আমি নিশ্চিত হই, এই ঘটনার রেশ আমাকে বয়ে যেতে হবে আজীবন। একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ফলাফল হলো, আমি আর কখনোই আমার হাতে পুরোপুরি শক্তি ফিরে পাবো না।
কিন্তু যারা আমার জীবনে এমন নরক নামিয়ে এনেছিলো, তারা আছে। খুব ভালোই আছে। দাপটের সাথে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে শিবির বলে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করছে। বিচার তো দূরের কথা, আমি নিজেই আমার ক্যাম্পাসে আর ঢুকতে পারবো কি না, সেটাই অনেক বড় একটা প্রশ্ন।
তবে, বিচারের আশা আমি করি না।
বৃহস্পতিবার রাতে আমার উপর নির্যাতন করা হয়। শুক্রবার সারাদিন আমি একা একা পড়েছিলাম হাসপাতালের বেডে। শনিবার শিক্ষকেরা আমার সাথে দেখা করতে আসেন। উনাদের কথা হলো, "অভিযোগ নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" আমার সারারাত জুড়ে করা চিৎকার আর আমার পুরো শরীর ভর্তি নির্যাতনের দাগ যাদের বিবেকের কাছে পৌঁছে নি, তাদের দরকার কাগজ।
আমি ওদের হাত থেকে ছাড়া পেলেও আমার ফোনটা ওদের হাতেই ছিলো। বাবা ফোন করলে রং নাম্বার বলে সেই ফোন কেটে দেওয়া হয়। বাবা ভয় পেয়ে নরসিংদী থেকে বরিশালে রওনা হন।
এবং আমাকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই প্রথমবারের মতো। আমি এর আগে কখনোই বাবাকে কাঁদতে দেখিনি।
যেই বাবা ছিলো আমার সাহস, প্রেরণা আর পরিশ্রমের উৎস, যেই বাবা চরম অভাবের সময়ও আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, তোকে পারতেই হবে, যেই বাবা তীব্র না পাওয়ার সংসারেও পড়াশোনার বাতিটা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন নিজের গায়ের রক্ত দিয়ে, সেই বাবা আর পারলেন না, বললেন, তোমার আর পড়াশোনার দরকার নাই।
ভিডিও কলে আমার অবস্থা দেখে আমার মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
নিজের মা বাবাকে অসহায় হয়ে কাঁদতে দেখা একটা ছেলের কাছে সবচেয়ে কষ্টের অভিজ্ঞতা। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমার আবারও সেই নরক দর্শনের অভিজ্ঞতা হলো। মা বাবা ভেঙে পড়লে সেই পরিবারের আর থাকেটা কী? একটা মাত্র রাত, এভাবেই আমাকে আর আর আমার পরিবারকে তছনছ করে দিয়ে গেল।
বন্ধুত্ব, মানবতা, সভ্যতা, বিবেক শব্দগুলো এখন আমার কাছে তাই অবাস্তব লাগে। নাকি এক রাতের জন্য সেদিন এই ক্যাম্পাস থেকে ঈশ্বর শব্দগুলো আসমানে তুলে নিয়েছিলেন? একটা মানুষও আমার জন্য এগিয়ে আসেনি। না শিক্ষক, না বন্ধু, না সিনিয়র। অথচ এই ইউনিভার্সিটিতেই তো আমাদের মানবতার সবক দেওয়া হয়, তাই না?
না, আমি বাবার কথা শুনিনি। বাড়িতেও ফিরে যাইনি। বরং বাবার জ্বালানো সাহসের সলতেটা এখনও ধরে আছি। আমি আমার উপর হওয়া অত্যাচারের বিচার চাই। লেখাপড়া শেষ করে মা বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।
এখন যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, আমার ভেঙে যাওয়া হাতে আর শক্তি ফিরে আসবে না। তবে আমরা মেরুদন্ডটা যদি শক্ত করি, হয়তো ভবিষ্যতে আর কোন মুকুলকে ভাঙা হাত আর ভাঙা অন্তর নিয়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হবে না।
আর চাই, আমার মতো এমন নরক যেন এই ক্যাম্পাসে আর কারো উপর কোনদিন না আসে। আর কোনদিন কোন বাবাকে যেন এমন করে তার সন্তানকে নিয়ে চলে যেতে চাইতে না হয়।
ইউনিভার্সিটি আমাদের স্বপ্ন পূরণের আতুর হোক। স্বপ্ন ভঙ্গের না।
মুকুল আহমেদ
সেশনঃ ২০১৯-২০
ইংরেজি বিভাগ
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
ফুটনোট: মুকুলের উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা ‘সোচ্চার’ এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কামালের জবানবন্দী ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা হয় নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
সম্ভাব্য শাস্তি: বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমানিত হলে নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা হতে পারে। কর্তব্যে অবহেলা এবং নির্যাতনে সহায়তার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১১৫, ১১৬ এবং ১১৯ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।