
তখন যদি সত্যি সত্যিই আমাকে দত্তক দিয়ে দিতো, তাহলে হয়তো আজ এখানে আমাকে এভাবে মার খেতে হতো না!!
বড় ফ্যামিলিতে জন্ম। বাবা কৃষক। তাই অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলো, আমাকে যাতে দত্তক দিয়ে দেয়। বাবা দত্তক দেয়নি। বরং ছোট ছেলে হিসেবে আদর যত্নের সাথেই মানুষ হয়েছি। যেই যত্ন থেকেই খুব সম্ভবত আমার বড় ভাইয়ের চাওয়া ছিলো আমি যেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার নিজেরও যে চাওয়া ছিলো না, তাও না। তাই জগন্নাথ ইউনিভার্সিটির ফার্মাসী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথ ছেড়ে আমি ভর্তি হই ঢাকা ইউনিভার্সিটির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে আমার জীবনে কী আজাব নিয়ে আসতে যাচ্ছে, আমি তখনও বুঝিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কথা চালু আছে। এখানে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আপনি মূলত হলের সম্পত্তি। আমি বরাদ্দ পেলাম ফজলুল হক মুসলিম হলে। এখানেই আমি একদিন বিশাল একটা অপরাধ করে ফেললাম। যে অপরাধের কোন ক্ষমা নাই। যদিও তখনও আমি জানতাম না যে বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিগুলোতে পলিটিকাল বড় ভাইদের নাম মুখস্থ রাখতে না পারাকে এতো বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমাকে আর আরেকজনকে মারধোর করা হলো। মারধোর করা সবার নাম মনে না থাকলেও ফয়সাল ভাই আর আরিফ ভাই, এই দুজনের নাম মনে আছে। আমরা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিলাম। তবে এই ঘটনার বহুদিন পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে পারিনি। স্বপ্নের রঙিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন আমার কাছে একটু একটু করে ধূসরে পরিণত হচ্ছে। তখনও জানি না, এইটা ট্রেইলার। আসল "সিনেমা" এখনও বাকি। যে সিনেমা আমার জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে বাকি জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে।
২০১৩ ফেব্রুয়ারিতে আমার বাবা মারা গেল। বাসা থেকে হলে ফিরতে তাই দেরিই হলো কিছু দিন। ততদিনে গণরুম থেকে নিজের একটা রুম পেয়েছি। ৩০০৩ নম্বর রুমে ফ্লোরিং করে থাকি।
তখন শাহবাগের উত্তাল সময়। শাহবাগ থেকে নবিজীকে নিয়ে কটুক্তি করা হলো। তার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বারো দল বায়তুল মোকাররাম থেকে একটা বিক্ষোভ কর্মসূচী দেয়। ঐদিন বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ পড়াই আমার জন্য কাল হয় দাঁড়ালো। নামাজের পর মিছিলে পুলিশ টিয়ারশেল মারার পর আমি আর আমার বন্ধু খালেক আনন্দবাজারের দিকে চলে আসি। ওখান থেকেই ছাত্রলীগের কিছু ছেলেপেলে আমাদেরকে ধরে আনে একুশে হলে। এবং কোন কিছু না বলেই আমাদেরকে লাঠি-সোটা দিয়ে মারতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমাদের ময়মনসিংহেরই মুক্তাদির ভাই আমাকে সেভ করেন এবং কিছু বন্ধুবান্ধব আর ডিপার্টমেন্টের লোকজন সাথে দিয়ে আমাকে আমার হলে পাঠিয়ে দেন। ভেবেছিলাম যাক, তাও শেষ হলো। আসলে ঐটাই ছিলো শুরু। এরপর আমার হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে শুরুতেই আমার ফোন কেড়ে নিয়ে চেক করতে থাকে। ওদের ধারণা ছিলো, আমি শিবির করি। যদিও ট্রাঙ্ক ভেঙে কিছুই পায়নি তেমন। আমাকে আর খালেককে দ্বিতীয় দফায় ডাকা হয় এক্সটেনশন বিল্ডিং এ। তখনও আমার ফোন ওদের হাতে। চেকিং চলছেই। এখানে আমাদের এক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখানে উপস্থিত ছিলো রুবেল, রাশেদ ভাই, আরিফ, মাহফুজ আর রকিব।
প্রথম ধাপের রিমান্ড শেষে এবার আমাদের নেওয়া হয় মেইন বিল্ডিং এ।ওখানে বড় ভাইরা আমাদের "রিমান্ড" নেবে। নিজেকে আমার তখন মানুষ না মনে হচ্ছিলো খাঁচায় বন্দি কোন প্রাণী। যে রাজনীতি একজন ইউনিভার্সিটির ছাত্রকে এমন জানোয়ারে পরিণত করে, সেই রাজনীতি থেকে আমরা মুক্তি পাবো কবে? এখানে এসে বড় ভাইয়েরা আরেক দফা চেক করে। আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। বায়তুল মোকাররামে গিয়েছি শোনার সাথে সাথে আমাদের মারতে শুরু করে। বেশ কয়েকজন এই মারধোরের নেতৃত্ব দেয়। তার মধ্যে একজন ইব্রাহিম মিয়া, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজির এসিস্টেন্ট প্রফেসর হন (বর্তমানে অস্ট্রিলিয়াতে অধ্যায়নরত)। আরেকজন নেতা, রাফিউল ইসলাম, আমাকে মারার পাশাপাশি আমার গ্রামে খোঁজ নিতে শুরু করে, আমি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত কি না, জানতে।
গ্রামে ফোন দেওয়ার পর আমার ভাইয়েরা বেশ কিছু নেতাদের দিয়ে নিশ্চিত করায় যে আমি কোনকিছুর সাথে জড়িত না। বাট এতে কোন লাভ হয় নাই। বরং এরা দাবি করতে থাকে যে আমার নামে অনেককিছু পেয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর আমার ভাই আবার ফোন দেয়। তখন আমার ভাইকে উত্তরে বলা হয়, আপনার ভাইকে আর জীবিত ফেরত পাবেন না। তারচেয়ে বলেন সবকিছু স্বীকার করে নিতে। এই পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছে মোঃ ইব্রাহিম মিয়া, রাফিউল ইসলাম আর মোঃ শফিকুল ইসলাম । এর পাশাপাশি আরো ছিলো সাইমন, আনোয়ার, তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি হাসানুজ্জামান আর মো: শোয়েব আব্দুল্লাহ ( বর্তমানে বাংলাদেশ এম্বাসি, নেপালের পলিটিকাল কাউন্সিলর)। ততক্ষণে পুরো হল ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে আমাদের দেখছে। কিন্তু এগিয়ে কেউই আসেনি। কার ঘাড়ে দুইটা মাথা? শাহবাগ থেকে স্লোগান আসছে। একটা একটা শিবির ধর। ধইরা ধইরা জবাই কর। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কেউই ছিলো না।
রাত আটটা।
ওদের একটু থামতে দেখে মনে হলো, এবার বুঝি শেষ হলো। কিন্তু না, বরং আমার কল লিস্ট চেক করে সালাহউদ্দিন নামের আরো একজনকে ডেকে নেওয়া হলো। তারপর মার শুরু। মারধোর করা হচ্ছিলো গ্রুপ করে গ্রুপ করে। একেক গ্রুপ একেকজনকে মারার মহান দায়িত্ব তুলে নিলো কাধে। এর মধ্যে রকিব হাসান আর আজিজুল হক ভাই মারের ফাঁকে ফাঁকে দিচ্ছিলেন আলোচনার প্রস্তাব। স্বীকার কর। স্বীকার করলেই মুক্তি। কিন্তু কিছুই স্বীকার করিনি। কী স্বীকার করবো? কোন অন্যায় করিনি? একদিকে তীব্র যন্ত্রনা অন্যদিকে মনে পড়ছিলো বাবার কথা। তবে কি আমিও তার কাছেই চলে যাবো? মৃত্যুকে সহজ মনে হয় আর জীবনকে কঠিন, এমন যন্ত্রনা কেন দাও খোদা? এমন সময় তীব্র শব্দ আর যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠলাম। হাড় ভাঙলো নাকি? ভাঙার মতত হাড় এখনও অবশিষ্ট আছে তবে? চোখ মেলে দেখি, হাড় না। মারতে মারতে হকিস্টিকই ভেঙে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাই। সেই সুযোগ হয় না। তার আগেই দেখি স্ট্যাম্প আর রড। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই। কোন সাহায্য আসে না। আমার এই চিৎকার হলের ছেলেপেলের কানে গেলেও হল প্রভোস্ট এর কানে গেছিলো কি না, জানি না। তবে হাউস টিউটরের কানে গেলেও তিনি চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি। এরপর শোয়েব আব্দুল্লাহ সিগারেট দিয়ে ছ্যাকা দেওয়ার পর আমার চিৎকার করার শক্তিও আর ছিলো না। ওদিকে শফিক তখনও সালাহউদ্দিন ভাইকে মারতেই আছে।
এক পর্যায়ে একজন এসে আমাকে উঁচু করে তোলে। একটু পানি দেবে নাকি? তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যায়। তবে পানি না, হাসানুজ্জামান আমাকে চড় মারতে শুরু করে। আমার গাল ফুলে যায়। পরবর্তীতে এই থাপ্পড়্ আমার দাঁতের ইনফেকশনের কারণ হয়েছিলো। ওদের কথা ছিলো একটাই। আমাদের কাউকে জীবিত ফেরত যাইতে দেবে না। আমার মৃত বাবার কথা,আমার মায়ের কথাও ওদের মন এতটুকু গলাতে পারে নাই। পাথর দিয়ে তৈরি করা হৃদয় বুঝি এমনই হয়? বাট আমার শরীর তো আর পাথরের না। রক্ত মাংসের। কাজেই, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এরপর? সবকিছু অন্ধকার।
পরিশিষ্ট:
আমার জ্ঞান ফিরে আসে রাত দুইটাতে। প্রক্টর স্যার দুধ খাইয়ে আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। শাহবাগ থানায় মামলা হয়। দুইটা মামলা। যার একটার রেশ আমাকে আজ পর্যন্ত টানতে হচ্ছে। ৪৬ দিন জেলে থাকতে হয়েছে, আমার দুঃখ নাই। দুঃখ একটাই, মামলায় বলেছে ৬ তারিখ ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে আমি নাকি গাড়ি পুড়িয়েছি। অথচ যার বাবা মারা গেছে ২ তারিখ, সে ৬ তারিখ গাড়ি পোড়াতে পারে? অনেক বলার চেষ্টা করেছি। লাভ হয় নাই। শাহবাগের বাংলাদেশ। শিবির বলে যা তা করা জায়েজ। এরপর আমার ক্যাম্পাস লাইফ বলে আর কিছুই ছিলো না। আমি ক্লাস করেছি মানুষের মতো না, তাড়া খাওয়ার ভীত এক শিকারের মতো। বন্ধুরা বলে দিতো অমুক দিক দিয়ে আসিস, আমি এসে ক্লাস করে চলে যেতাম।
এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। অথচ এখনও এই ঘটনা বলতে গেলে শিউরে উঠি, ফিরে আসে সেই রাতের ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্ন কি কোনদিন শেষ হবে? আমি জানি না। আমার হারিয়ে ফেলা জীবন কেউ তো আর ফিরিয়ে দেবে না। শুধু একটাই চাওয়া, দোষীদের যেন বিচার হয়। যেন আর কোনদিন কাউকে কোন ট্যাগ দিয়ে এমন দুঃস্বপ্ন আর কোন দল উপহার না দিতে পারে!
মো: কামাল উদ্দিন,
মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ ;
ফজলুল হক মুসলিম হল,ঢাবি
সেশন : ২০১১-১২
ফুটনোট: কামালের উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা ‘সোচ্চার’ এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কামালের জবানবন্দী ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা হয় নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
সম্ভাব্য শাস্তি: বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমানিত হলে নির্যাতনে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা হতে পারে। কর্তব্যে অবহেলা এবং নির্যাতনে সহায়তার কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১১৫, ১১৬ এবং ১১৯ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।